আপনার গল্প
বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে বিবস্বানে আপনার গল্প পাঠান। বিবস্বান এর blog এ আপনার গল্প নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত
হবে।
--------------------------------------------------------------------
বুকানের প্রার্থনা
মৃন্ময় ভৌমিক
বাড়ির সমানের রাস্তাটা এতটা ফাঁকা এর আগে
কোনদিন দেখেনি বুকান। শেষ বার কি সেই ভোটেও ফাঁকা ছিলো কিন্তু এতটা নয়। প্রতিদিন
সাইরের শব্দ, নীল রঙের ছাপা ছাপা জামার লাঠি ধারি পুলিশ দেখে অবাক হয়ে যায়
বুকান। বাবা’র কাছ থেকে শুনেছে এদের নাকি র্যাপ বলে। অন্যায় দেখলেই এর শাস্তিদেয়। বুকান বলে –‘আমাদের হেড মাষ্টার
শান্তি বাবুর মতো । অন্যায়কে একদম প্রশ্রয় দেননা তিনি।’ কতদিন
ইস্কুল যাইনি সে। তার
বন্ধুরা কেমন আছে কি জানি ? মাষ্টার মশায় একদিন এসেছিলেন তার খোঁজ নিতে । তারপরও
অনেক দিন কেটে গিয়েছে। তা বলে বুকানের কিন্তু একটুও মন খারপ নেই । সে প্রতিদিন
সকালে উঠেই জ্যেঠুর সাথে ছাঁদে গিয়ে ব্যম করছে, যোগা করছে। জলখাবেরর বিশাল
টেবিলটায় সে আর একা নয় । দাদু, জ্যেঠু, কাকাই,
পুগলাই, মিঠাই, জ্যেম্মা,
ঠাম্মা, বাবা, মা সবাই মিলে জমে গিয়েছে। এখন আর বুকানের মনে প্রশ্ন জাগেনা এত বড় বাড়ী
এত বড় খাওয়ার টেবিল, এত বড় ডাইনিং কিসের জন্যে আছিতো তিন জন।
এখন ঠিক সময় না পৌঁছালে বুকারের সবচেয়ে পছন্দের সিটটা দখল করে নেবে মিঠাই।
‘দেখ মিঠাই, তুই কিন্তু ছোট। ছোট ছোটোর মত
থাক। বেশি বকিস না। জানিস আমি ক্লাস থ্রি তে পড়ি আর তুই কেজি টু। ওটা আমার জায়গা’। মিঠাইও নাছোড় বান্দা শেষে বাবার আদেশে বুকান
হেরেছ। তাও মজা আছে। মিঠাইরা থাকে ব্যাঙ্গালোরে। এই অচেনা অজান কি ভাইরাস রোগ মাথা চাঁড়া দিতেই জ্যেঠু, জেম্মা আর মিঠাই এসেছে
কোলকাতায়। বাবা চলে এসেছে দিল্লী থেকে অফিস এখন বন্ধ । কাকাই, কাকিমা আর
পুগলাই দা থাকতো সল্টলেকে। পুগালই দা ইঞ্জিরিয়ারিং পড়ে ।
সকালের ব্যামের পরে চা জলখাবের আড্ডায় কাকাইয়ের
তামাস বেশ লাগে বুকানের। কিন্তু তার থেকেও ভালো লাগে পুগলাই দাকে। পুগালিদা অনেক
গল্প জানে দেশ বিদেশের গল্প, কতঘটনা বুকান শোনে স্বপ্ন দেখে
সে সেসব দেশ গুলোতে বড় হলে যাবে। পুগালি দা আসলে কিন্তু লেখাক খুব ভালো গল্প,
কবিতা লেখে। সে বলেছে কানে কানে – ‘জানিস বুকান আমি সাহিত্যিক হতে
চেয়েছিলাম।’
সবাই আছে সবিতা পিসি আসছেনা আর, তার আসা
বারণ। বাড়িতে এখন কত লোক তাই রান্নার অসুবিধে নেই কিন্তু বুকান তার পুগালাইদার
কাছে শুনেছে আমাদের সবিতা পিসী, রিক্সা গোপাল
কাকু , সেলিম সব্জি কাকা এদের অবস্থা
ভালো নয়। অনেকে নাকি কাজের জায়গা থেকে আজও বাড়ীই ফিরতে পারেনি। তারা কি খাচ্ছে
কোথায় থাকছে তাদের কিছু হবে না তো ? ভবে বুকান।
কত নিয়ম নাকে মাস্ক পরতে হবে, সাবান দিয়ে
বার বার হাত ধুতে হবে, বাড়ী থেকে একদম বেরানো যাবে না,
ঘর, রাস্তা ব্যবহারকারী সমগ্রী সব সময়
পরিষ্কার রখাতে হবে বুকান এই সব কিছু জানে বাড়ির সবাইকে বলেও। স্কুল ছুটির দিন ক্লাস টিচার
তাদের সুন্দর করে বুঝয়ে দিয়েছে সবটা।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন উপস্থিত তখন
দাদু সবাইকে বললেন – ‘আজ আমার সবাই খাওয়ার আগে ঈশ্বরের কাছে হাত জড়ো করে প্রার্থনা করবো
সারা পৃথিবীতে কত মানুষ এই রোগ থেকে বাঁচতে কঠিন লড়াই করছেন তার যাতে দ্রুত সুস্থ
হয়ে ওঠেন আর আমাদের সুন্দর পৃথিবীটা যেন আবার আগের মতো হয়ে যায়।’ এর মাঝে পুগলাই দা হঠাৎ বলে
উঠলো ‘আর দাদু ধন্যবাদ জানাবো সে সব ডাক্তার, নার্স
সেবাবন্ধু, সাফাই বন্ধু আর
পুলিশদের যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের জন্যে এত পরিশ্রম করছেন’। সবাই রাজি হলো। কিন্তু বুকানের মন ভারি হয়ে আসে, চোখ ছল ছল
করছে তার। কাকাই বুকানের মাথার হাত দিয়ে বলে ‘কি হলো ? তুমি
চাওনা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে ?’ বুকান মাথা নেড়ে হ্যাঁ
বলে। তাহলে ? প্রশ্ন করে বুকানের জ্যেঠু । বুকান এবার কাঁদো
কাঁদো গলায় উত্তর দেয় ‘চাই না সব ঠিক হয়ে যাক। আমি এত বড় বাড়ী, এত বড় ডাইনিং
রুম আর ফাঁকা খাওয়া টেবিল দেখাতে চাইনা। পুগলাই দা ছাড়া দুপুর গুলো কি হবে। মিঠাই তুই
থাক আমার পছন্দের সব কিছুই তোকে দিয়ে দেবো তুই ফিরে যাস না প্লিজ... ’
___________________________
ছবিটি তৌসিফ হক এর দেওয়াল থেকে সংগৃহীত। ছবিটি
এঁকেছেন তৌসিফ হক।
ধন্যবাদ জানাই তাকে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
একটি অনু
গল্প
লেখক –অনামিকা মণ্ডল সেন্নগুপ্ত
একই অফিসে, একই ডিপার্টমেন্টে, একই পদে চাকরি করে
দুই বান্ধবী। সেই সুবাদেই বান্ধবীর দাদার সাথে ভালোবাসা, প্রেম,..বিয়ের পর ও বন্ধুত্ত অটুক। একই সাথে অফিস যাওয়া, আসা...
বাড়ী ফিরলে শ্বাশুড়ী.. ডেকে বলেন... বৌমা তোমার ননদকে চা, জলখাবার
দাও। বেচারির অফিসে কতো খাটুনি। ওকে একটু বিশ্রাম দাও।আর তুমি রাতের রান্নাটা
বসিয়ে দাও।সারাদিন তো বাড়ী থাকো না। সংসারের তো কিছুই করতে হয়না। রাতের রান্নাই না
হয় একটু করো। ক্ষুদার্থ বধুটি চা টুকু ও মুখে দিতে পারে না। তাড়াতাড়ি রান্না সারা
না হলে যে রাতের খাওয়া খেয়ে শুতে দেরী হয়ে যাবে... কাল যে আবার সকালেই অফিস....
-------------------------------------------------------------------------------------------
বিয়োগের পর যোগ
লেখক- সৌমিত্র বসু
ভাস্বতী আজ সকাল থেকে খুব
ব্যাস্ত। RBB, Royal Bank of Britain এর কর্মী সনত চ্যাটার্জী আজ থেকে ভারতবর্ষের National Head - Corporate Banking।
উফফ্। কোনোদিন ভাবেনি ওরা
দুজনেই। দুজন, সনত আর ভাস্বতী। খুব, খুউউব মনে পড়ছে সেইদিনটার কথা, যেদিন সনত প্রথম
চাকরির অফার পেয়েছিল। সাধারন Sales
Officer এর চাকরি। Grade 2, Sales Officer।
ভাস্বতী আর সনতের জীবনে, বিয়ের পরে সবচেয়ে আনন্দের দিন। 04/11/2004। অফার লেটারটা পেয়ে খুশী ধরে রাখতে পারেনি দুজনেই। বিয়ের সময়
সনত Global Trust Bank এ
চাকরি করতো। 2004 এ OBC যখন অ্যাকুইজিসন করলো GTB কে, তখন সাধারন মানের
কর্মী সনত চ্যাটার্জীকে রেখে দেওয়ার মতো কোনো কারন ছিলোনা Oriental Bank of Commerce এর কাছে।
তিন মাস। পাক্কা তিন মাস, বেকার বসেছিল সনত। আর সেই নব্বই দিনের সনতের কষ্টটা খুব কাছ
থেকে বুঝতে পেরেছিল ভাস্বতী। সনতের জন্য অবিশ্যি ঐ নব্বই দিন খুব গুরূত্বপূর্ন
ছিলো নিজেকে চেনার জন্য। নিজের ভুলগুলো বোঝার জন্য। নিজেকে কীভাবে একজন পুরোদস্তুর
প্রফেসনাল করা যায়, নিজের স্পোকেন ইংলিশ কে কী করে আরও
তুখোড় করা যায়, দিনের পর দিন নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে শিখিয়েছিল
সনত ঐ সময়। সকালে ভাস্বতী কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পর, রোজ নিয়ম
করে বিভিন্ন জায়গায়, কোম্পানীতে, কনসালটেন্সিতে
ঘুরতো সনত। প্রিয় Wills Navy Cut কে অনায়াসে সরিয়ে ফেলেছিল সনত নিজের জীবন থেকে। ভাস্বতীর একার
রোজগারে সংসার চলেছে। ভাস্বতীও তখন নতুন উকিল কোর্ট চত্বরে। তাও তো ওরা কাটিয়ে
নিয়েছিল ঐ তিনটে মাস। ভাস্বতী এখনও মনে করে ঐ তিনটে মাসে ওরা মানসিকভাবে সবচেয়ে
সুখী ছিলো। সেবার পুজোয় ওরা দূরে কোথাও যায়নি। কিন্তু ম্যাডক্স স্কোয়ারে বসে সনতের
হাতটা জড়িয়ে ধরে দশ টাকার আইসক্রিম খাওয়ার আনন্দটা যে ফাইভ স্টার কোনো হোটেলে
বাফেট লাঞ্চ বা ডিনারের থেকে অনেক শান্তির, সেটা এখনও মনে
করে ভাস্বতী।
হঠাতই একটা কনসালটেন্সির থেকে
কল পেয়ে ইন্টারভিউ, আর প্রায় সাথে
সাথে চাকরির অফারটা পেয়েছিলো ততদিনে অনেক বেশী সপ্রতিভ সনত। অন্ততঃ GTB এর সনতের থেকে অনেক
পরিনত, সেইদিনকার সনত চ্যাটার্জী।
চাকরিটা পাওয়ার পর শুধুই
নিজের পারফর্মেন্সকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়েছিল সনত। ভাস্বতী বাধা দেয়নি। কারণ
সনতের ঐ তিনমাসের কষ্টটা সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছিল ভাস্বতী। পাশাপাশি শুতো এক
বিছানায়। কিন্তু সেটা শুধুই শোয়া। বাচ্ছা নেওয়ার কথা একবার মুখ ফুটে বলেও ফেলেছিল
সনতের কাছে। সনত রাজী হয়নি, ওর হাতটা বুকে
নিয়ে বলেছিলো, "পুচু এই ইয়ারের টার্গেট টা হয়ে গেলে
একটা বড়ো প্রোমোশন হয়তো পাবো, তখন আমরা এগুলো নিয়ে ভাববো
সোনা। প্লিজ। এখন শুধুই নিজেদের কেরিয়ারটা গুছিয়ে নি পুচু। প্লিজ সোনা। ভুল
বুঝোনা।" নাহ্ ! ভুল বোঝেনি ভাস্বতী।
Sales Officer থেকে Asst. Manager
- Sales, সেখান থেকে Sales Manager হয়ে
Branch Manager। আর Branch Manager থেকে Regional
Manager এর গদিতে বসতে সনত চ্যাটার্জী সময় নিয়েছিলো
সাকুল্যে মাত্র সাত বছর। কিন্তু কথা রেখেছিলো সনত। Regional Manager হিসাবে
জয়েন করার সপ্তম দিনেই আগামীর বীজ পুঁতেছিলো ভাস্বতীর গর্ভে। তবে সেটা প্রেমের
শারীরিক মিলনের চেয়েও বেশী ছিলো, দায়সারা বংশ্ববৃদ্ধির
প্রক্রিয়া। মিলনের শেষে তৃপ্ত ভাস্বতী মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছে, সনত একমনে Laptop এ কাজ করে যাচ্ছে।
Regional Manager সনত চ্যাটার্জী মেয়ের জন্মের সময়ও থাকতে পারেনি Belle Vue তে। কুনালই
একা দৌড়াদৌড়ি করেছে সবকিছুর জন্য, ভাস্বতী আর সনতের
পরিজনদের সাথে। এমনকি নবজাতকের আনন্দ সংবাদও সনতকে মেসেজ করেছিলো কুনাল, অন্যান্য সব আত্মীয়দের আগে। ব্যাস্ত সনত তখন মিটিং এ ছিলো ভুবনেশ্বরে।
কুনাল। কুনাল বোস। ভাস্বতীর
কলেজের বন্ধু কুনাল। লালবাজার ডি.ডি.র সুচতুর, উচ্চাভিলাষি
পুলিশ অফিসার কুনাল বোস। এক আশ্চর্য বৈপরিত্যের কুনাল বোস। 24 ঘন্টা এক
নাগাড়ে খাটতে পারা কুনাল। আবার রোজকার কাজের শেষে মদের বোতোলের সাথে সময় কাটানো
কুনাল। ভাস্বতী সনতের সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলো ওরা দুজন বাদে এই একজনই দেখেছিল খুব
কাছ থেকে। পরিপূর্ন গর্ভবতী ভাস্বতীকে রাতের পর রাত
একলা রেখে সনত বাইরে কাজে
গেলে, কুনাল রাতের আয়ার সাথে রাত জেগেছে। তিতলি
জন্মানোর পর, একলা ভাস্বতী যখন মাঝেমাঝে ঘুমোতে চেয়েছে,
কোন এক আশ্চর্য্য উপায়ে সেটা জেনে, লালবাজার
থেকে সোওওজা সনতদের ফ্ল্যাটে এসে ভাস্বতীকে বলেছে,"তুই
ঘুমো, আমি আছি তো"। সেই আওয়াজের মতো নির্ভরশীল আওয়াজ
ভাস্বতী শুনতে পেতো ওর বাবার গলায়।
তিতলি ধীরো ধীরে বড়ো হয়েছে, আর সনত আরো ব্যাস্ত হয়ে গেছে ওর কাজ নিয়ে। কোর্ট শব্দটা এখন
প্রেম শব্দটার মতোই ভুলে গেছে একসময়ের অ্যাডভোকেট ভাস্বতী চ্যাটার্জী।
তিতলির পাঁচ বছর বয়সের
জন্মদিনের দিন Zonal Manager এর প্রোমোশন পেয়েছিলো সনত। তার পাঁচ বছর পর দিনরাত এক করে খেটে
সনত চ্যাটার্জী National Head -
Corporate Banking এর চেয়ারের দখল নিল
PAN India র আরো তিনজন
ক্যান্ডিডেট কে হারিয়ে।
আজ ভোর সাড়ে চারটের সময়
বাড়ি ফিরেছে সনত পুনের Head Office থেকে। আজই কোলকাতার অফিসে শেষদিন Zonal Manager হিসেবে।
আজ সব hand over করতে হবে নতুন Zonal
Manager ত্রিলোকেশ্বর পান্ডা কে। পরশু থেকে সনত আর
ভাস্বতীর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা কোলকাতার সাথে। ব্যাঙ্কের পুনের বাংলোতে গিয়ে উঠবে
ওরা। ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দেবে ওরা। সেটা পরে করলেও হবে। আপাততঃ চাবি দিয়ে চলে
যাবে সনতের বোনের কাছে।
তিতলি এখন দেরাদুন কনভেন্টে
পড়ছে। ক্লাশ ফোর। কুনালের সাথে প্রায় অনেকদিন যোগাযোগ নেই। হঠাত করেই হারিয়ে গেছে
কুনাল। শেষ খবর পেয়েছিলো মহুয়ার কাছে। কুনালের পিসতুতো বোন মহুয়ার কাছে। বিয়ের
প্রায় সাত মাস পরেই সেপেরেসন্ হয়ে যায় কুনাল আর স্বাতীর। তারপর যা হয়, ডিভোর্সের কেস চলেছিলো প্রায় দুবছর। কুনাল পুলিশের চাকরিটা
ছেড়ে দিয়ে হরিদ্বারে থাকে। কোনো একটা বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার হয়েছে ওখানে।
কাল রাত নটার সময়ে হঠাত
ফ্ল্যাট অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। ভাস্বতী প্রথমে ভেবেছিলো বুঝি লোডসেডিং। কিন্তু যখন
আর সমস্ত ফ্ল্যাটো পরিপূর্ন আলো দেখলো,তখন
সিকিউরিটিকে ফোন করলো ভাস্বতী। সিকিউরিটির থেকে তলব পেয়ে গঙ্গানীড় প্রোজেক্টের
ইলেক্ট্রিসিয়ান এসে ফ্ল্যাটের সব দেখেশুনে বললো, "ম্যাডাম
দরজাটা খোলা রাখুন। আমি মেইন মিটারটা চেক করছি।"
অন্ধকার ফ্ল্যাটে সাদা চাদরে
ঢাকা আসবাবগুলো একটা মাত্র এমার্জেন্সির আলোয় কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছিল। একটু ভয় ভয়
করছিলো ভাস্বতীর। অনেক বছর পর আজ একা আছে ভাস্বতী। আজই চাঁপাকে মাইনে আর বোনাস
দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ভাস্বতী। কাল রাত 2টোর
ফ্লাইট। এই শেষ একটা দিন, বাপের বাড়িতে যাবে একবার।
দরজাটা একবার হাল্কা খুলেই
বন্ধ হয়ে গেলো। একজন আলো আঁধারির মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো,"কীরে পাগলি চিনতে পারছিস?"
"কুউউনাল,
তুই? এখন? ব্যাপার কী
তোর অ্যাঁ?" এক নিঃশ্বাসে বললো ভাস্বতী। "খুব বাড়
বেরেছিস কুকুর। কোলকাতা ছাড়ার সময় বলে যাসনি কেন? জবাব
দে।"
"দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে বলবো নাকী?" সোফায় বসতে বসতে বললো কুনাল।
"আজই কোলকাতায় ফিরলাম রে।"
"আসলে তোকে
দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো তাই এলাম।" একটু থেমে মাথাটা নীচু করে বললো,
"ডিভোর্সটা হয়ে গেলো রে। আজই লাস্ট ডেট ছিলো। এখন আমি একদম
মুক্ত।"
"কী করো হোলো
কুনাল এইসব। তুই কী টর্চার করেছিস স্বাতীকে? আমায় সত্যি
বল।"
"কী বলছিস কী
ভাস্বতী? বিয়ের পর ঘরের কাজও তো আমিই করতাম। ওকে করতে দিইনি।
ব্যাঙ্কের চাকরি প্লাস চাকরীর পরীক্ষার পড়াশুনা করে ও সময়ও পেতোনা রে। কিন্তু ও বোধহয়
আমায় কোনোদিনও ঠিক ভালোবেসে উঠতে পারেনি সাত মাসে। নাহলে সাত মাসে কেউ ঘর ভাঙ্গে? আমার নামে 498A করার পর পরই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আমাদের চাকরিতে এইরকম একটা
দাগ লাগলে সবাই খারাপ চোখে দেখে রে। পাড়ার লোকেরাও আমার পিছনে আলোচনা করতো,
বুঝতো পারতাম। তাই চাকরিটা ছেড়ে মাকে নিয়ে চলে গেলাম।"
"জানিস ভাস্বতী,
আমার বোধহয় তোকে বিয়ে করা উচিত ছিলো। তুই আমি দুজনেই সুখী
হতাম.."
কুনালকে কথা শেষ করতে না দিয়ে
ভাস্বতী বললো, "প্লিজ কুনাল এসব কথা
বলিসনা। আর কে বললো তোকে আমি অসুখী? RBBর National Head এর স্ত্রী আমি। আমার মতো খুব কম মেয়েই সুখী। আর বিয়ের আগেতো তোকে বলেছিলাম, তুই তখন আমার ফ্যামিলির সন্মানের অজুহাত দেখিয়ে সরে
গিয়েছিলি।"
"তুই বলছিস
ভাস্বতী ? তুই? তোর তখন সনতের সাথে
বিয়ে ঠিক। তখন তুই আমার হাত ধরে বেরিয়ে এলে তোর মা বাবার সন্মানটা...."
"Will you please shut up kunal? প্লিজ এসব কথা বলতে আসলে, তুই চলে যা।
আর কোনোদিন আসবি না আমাদের বাড়ি। please
get out কুনাল।"
"আচ্ছা আমি চলে
যাচ্ছি। আর কোনোদিন আসবোনা তোর কাছে রে। সরি। আসলে আমার কপালে না সুখ নেই। চলি রে।
খুব ভালো থাকিস।"
দরজাটা হাল্কা খুলে বন্ধ হয়ে
গেলো। ভাস্বতীর ঘেন্না লাগছিলো কুনালকে "বাই" বলতেও। হয়তো এইরকম কোনো
মানসিকতার জন্যই স্বাতী ওকে ছেড়ে দিয়েছে, মনে
মনে ভাবছিলো ভাস্বতী।
"ম্যাডাম।
বাত্তি আ গ্যায়া।" সিকিউরিটি কখন যে গেট খুলে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি ভাস্বতী।
আজ সনত একটু দেরীতে রিল্যাক্স
হয়ে ব্রেক ফাস্ট করছে অনেকদিন পর। স্টার আনন্দে খবর পড়ছে সুমন। কয়েকটা Head Line এর পরই খবরটা
বিস্তারিত পড়লো সুমনের আওয়াজ। "হরিদ্বারে সূর্যতপা বৃদ্ধাশ্রমের বাঙালি
ম্যানোজার কুনাল বোসের কলকাতার বাড়িতে আত্মহত্যা। কাল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ
লেকটাউনে নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন একসময়ের দুঁদে পুলিশ অফিসার কুনাল বোস।
প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী দুপুরে হাওড়া কোর্টে ওনার ডিভোর্সের anouncement এর
পরই মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পরেন কুনাল বাবু। সন্ধ্যায় অনেকক্ষন ঘরের দরজা বন্ধ
দেখে ডাকাডাকি করেন ওনার দিদি। তারপর ঘর ভেঙ্গে......." আর শুনতে পারছিলোনা
ভাস্বতী। স্বামী গরবিনী সুখী স্ত্রী ভাস্বতী। দেওয়ালে মুখ গুঁজে কাঁদছিলো ভাস্বতী।
বুঝতে পারেনি সনত এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। ভাস্বতীর কাঁধে হাত রাখতেই, ভাস্বতী সনতকে আঁকড়ে ধরে বাচ্ছা মেয়ের মতো কাঁদতে থাকে।
"তুমি কুনালকে
খুব ভালোবাসতে না গো পুচু। আমায় কখনও বলোনি, কিন্তু আমি
বুঝতাম। ও তোমার জীবনের অনেকটা ছিলো।"
"বিশ্বাস করো
সনত। কুনাল আমার বন্ধু ছিলোনা, ভাই ছিলোনা, হয়তো প্রেমিকও ছিলোনা। ও ছিলো শুধুই কুনাল, শুদ্ধু
কুনাল। আর কিচ্ছু না। কিচ্ছুনা।" ভাস্বতীর চোখের জলে সনতের জামার বুকটা ধুয়ে
যাচ্ছিলো। সুমন পরবর্তী খবরগুলো এক এক করে পড়ে যাচ্ছিলো তখনও।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত।
-------------------------------------------------------------------------------------------
শিক্ষা
লেখিকা- তমালী চক্রবর্ত্তী
আজ ঘর পরিস্কার করতে বেশ
ব্যস্ত লেখা। ছেলে রূপ যে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে হোস্টেল থেকে কাল বাড়ি ফিরছে। তাই
তার ঘরটি ঝেড়ে সাফ করার জন্য অফিস থেকে লেখা আজ ছুটি নিয়েছে। রূপ শিবপুর
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল। লেখা ভেবে রেখেছে বিকেলেই সব
জিনিস আনিয়ে রাখবে, যা যা রূপ খেতে
ভালবাসে। এইকদিন ভালমন্দ সব রান্না করে তাকে খাওয়াবে। কে আছে তার রূপ ছাড়া?
যখন রূপ খুব ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্টে অরূপ মারা যায়। অরূপের চাকরীটা
লেখা পায়। কী ভাবে চাকরী সামলে লেখা, রূপকে একাহাতে মানুষ
করেছে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
মফস্বলের পুজোয় কলকাতার মতো
আড়ম্বর না থাকলেও মানুষজনের আন্তরিকতার অভাব নেই। কয়েকটা পাড়া মিলিয়ে এখানে
দুর্গাপূজা হয়। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই মিলেই পূজার কেনাকাটা,ঠাকুর আনা থেকে শুরু করে পূজার যোগাড়, বিসর্জন
সবটাই সুষ্ঠভাবে হাসিমুখে সামলে দেয়। ছোট ছোট টিম করা হয়েছে সবকিছু পরিচালনার
জন্য। রূপ এবার সেই টিমের একজন মেম্বার। অষ্টমীর দিন অঞ্জলীর পর বাড়ি ফিরে খেতে
খেতে মা কে জিজ্ঞাসা করল রূপ,
- মা, হালকা হলুদ- গোলাপী কম্বিনেশনের শাড়ি পরে একজন আজ এসেছিল অঞ্জলী দিতে,
ও কে গো? চেনো?
- আরে ওকে তুই চিনিস
নি? আরে তোদের সাথেই তো পড়ত। পাশের পাড়ার বিশু কাকার মেয়ে
অপরাজিতা।
- জিতা?...সত্যিই চিনতে পারিনি। এই চার বছরে অনেক বদলে গেছে।
লেখা হেসে বলল,
- তুই নিজে কী
বদলাসনি রূপ? আগে দাড়ি-গোঁফ রাখতিস না। এখন মুখময় জঙ্গল।
কতবার বললাম যে কাট, কিন্তু তুই বললি এটাই ফ্যাশান। কী যে
তোদের ছাতার ফ্যাশান বুঝিনা বাপু।
রূপ লুচির একটা টুকরো তরকারী
মাখিয়ে মুখে পুরে বলল,
- তোমার বুঝে কাজ
নেই। আচ্ছা তোমার তো সবসময় মনে হয় যে তোমার একটা মিষ্টি বউমা হোক। চাকরী পেয়ে আমি
যদি জিতা কে বিয়ে করি? তোমার আপত্তি আছে?
লেখা খুশি হয়ে বলল,
- আপত্তি কেন থাকবে?
কিন্তু জিতার ও তো তোকে পছন্দ হতে হবে। তবে তো বিয়ে। এখনই এতো ভাবিস
না, বুঝলি? আগে চাকরী পা, তারপর আমি নিজে গিয়ে বিশুদার সাথে কথা বলব।
--------
নবমীর দিন রাতে রূপের বাড়ি
ফিরতে বেশ দেরী হলো। সোফায় বসে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে লেখার কখন যেন চোখ
লেগে গেছে। দরজার আওয়াজ পেয়ে লেখার চোখ খুলল। ছেলের কাছে গিয়ে একটা বিশ্রী গন্ধ
পেল।
- ছিঃ রূপ। তুই মদ
খেয়ে এসেছিস? তোর লজ্জা করল না আমার সামনে এইভাবে আসতে?
আমি তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি?
- আজ ক্ষমা করে দাও
মা। আজ আমার খুব কষ্টের দিন। তাই বন্ধুরা জোর করে...
রূপের কথা বেশ জড়ানো। রূপ মা
কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। লেখা বেশ শঙ্কিত হলেও প্রকাশ করল না। রূপ কে ধরে ধরে
লেখা সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালো।
- কী হয়েছে সেটা আগে
বলবি তো? তবে না বুঝব।
- মা। সন্ধ্যেবেলা
প্যান্ডেলে আমি জিতা কে বলেছিলাম আমার মনের কথা। সবার সামনে আমাকে ও না বলে দিল।
অপমান করল। রূপ মিত্র কে অপমান করল। যার পেছনে কলেজে মেয়েদের লম্বা লাইন। তাকে না
বলল। আরো বলল যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, রজতের সাথে। ও রজতকেই
ভালবাসে। রজত....আরে রজত গো...মহামায়া স্টোরসের মালিকের ছেলে। বাপের মুদিখানা
সামলায়। শালা মাধ্যমিকও পাশ করতে পারেনি..ও আবার জিতাকে বিয়ে করবে...বোকা....
ছেলের কথাগুলো আর শুনতে পারলো
না লেখা। কী খারাপ সব ভাষা শিখেছে কলেজে গিয়ে। কই আগে তো এইরকম বলতো না। ছেলেকে
ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। এবার বেশ ভয় করছে লেখার। ছেলেটা বরাবরই খুব
রাগী আর জেদি। জীবনে যা চেয়েছে সেটা পেয়েই তবে শান্তি পেয়েছে। মা হিসেবে খুব
ভালোভাবেই জানে যে রূপের জেদ কত ভয়ংকর। কিছু চেয়ে যদি না পায় তা হলেই মুশকিল।
তখন রূপের ক্লাস ওয়ান। রূপের বন্ধুর
একটা পেন্সিল রূপের পছন্দ হয়েছিল। রূপ সেটা চাওয়াতে বন্ধুটা সেটা দেয়নি। তাতে রূপ
রেগে গিয়ে সেই বন্ধুর হাতে ঐ পেন্সিল টা গেঁথে দিয়েছিল,গভীরে। সেদিন অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে লেখা স্কুলে পৌঁছেছিল।
প্রিন্সিপাল ওয়ারনিং দিয়ে ছেড়ে দেয়। রূপকে খুব বকাঝকা করে লেখা। পরদিনই সে রূপ কে
ওইরকম একটা পেন্সিল কিনে দিয়েছিল।
রূপ যখন ক্লাস ফাইভ। লেখার
জীবনে নতুন পুরুষের আগমন ঘটে। লেখা নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাধা
দেয় রূপ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে লেখা রক্তাক্ত অবস্হায় আবিস্কার করে রূপকে। রূপ
নিজের হাতের শিরা কাটতে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ঠিক জায়গাটা জানতো না ছোট ছেলেটা। তারপর
লেখা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বিসর্জন দেয়।
পাড়ার এক নেড়ী কুকুর রূপের
খুব প্রিয় ছিল। রূপ সবসময় ওকে খেতে দিত, খেলত,
ছুটির দিনে শ্যাম্পু মাখিয়ে স্নান করাতো। একদিন খেতে দিতে গিয়ে রূপ
যখন ডাকে কুকুর টা কে। তখন কুকুর টা ঋকের বাড়ি থেকে বেরোয়। ঋক কে রূপ বরাবরই শত্রু
ভাবতো। পরেরদিন কুকুর টা রাস্তার মোড়ে, মরে পড়ে ছিল। লেখা
খুব ভাল করে জানতো যে এটা কার কাজ। যথেষ্ট বকেছিল ও রূপকে। তারপর রূপ ক্ষমা চায়।
বরাবরই লেখা ছেলের দোষগুলো সবার কাছে গোপন করার চেষ্টা করে গেছে, আড়ালে শাসন করলেও।
লেখা খুবই চিন্তায় পড়ল। কী
হবে তাই ভেবে।রূপ যদি নিজের ক্ষতি করে? অরূপ
নেই, কিন্তু রূপকে সে কিছুতেই হারাতে পারবে না।
------------
দশমীর দিন পুরো সকাল টা রূপকে
নজরবন্দী করে রাখল লেখা। কিন্তু রূপের মধ্যে কোনোরকম হেলদোল না দেখে মনে মনে
শান্তি পেল। রূপের আচরণ বেশ স্বভাবিক। যাক্!..ছেলে ভুলেছে তা হলে। সন্ধ্যের দিকে
রূপ জানালো যে সে একটু বেরোচ্ছে। সারাদিন ঘরে বসে থেকে ভাল লাগছে না। এছাড়া সকলকে
বিজয়ার প্রণাম করতে যেতে হবে। লেখা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের কাজ করতে লাগল।
------------
ঘন্টা দুই পর বেশ প্রফুল্ল
মনে রূপ বাড়ি ফিরল। লেখা টিভি দেখছিল। সে বিধবা মানুষ, মন্ডপে এইদিনটায় সে কোনোদিনই যায়না। মাকে বরণ তো আর করতে
পারবে না। তাই ঘরেই প্রতিবছর সে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায়। রূপ ঢুকেই মাকে
প্রণাম করল।
- অনেক বড় হও। মানুষ
হও। ভগবান তোমার মাথা ঠান্ডা করুক।
- ব্যাস? আর সুন্দর-মিষ্টি বউয়ের আশীর্বাদ কে করবে?
লেখা চমকে ওঠে কথাটা শুনে।
- মানে? সেটা তো পরে হবেই রূপ। আগে চাকরী পাও। তারপর সুন্দর দেখে একটা মেয়ে দেখে
তোমার বিয়ে দেব।
- মেয়ে কেন দেখবে?
জিতা তো আছেই। আর আমাদের বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। রজত সব জেনে
কিছুতেই আর ওকে বিয়ে করবে না। আমার কাছে আসতেই হবে জিতাকে।
ছেলের কথা শুনতে শুনতে হাত-পা
অসাড় হয়ে আসে লেখার। এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল।
- রজত কেন ওকে বিয়ে
করবে না রূপ?
- কেউ রেপ ভিক্টিম
কে বিয়ে করে মা? রূপ মিত্র কে অপমান? আমিও
আজ বুঝিয়ে দিয়েছি। এতো কীসের দেমাক? মা তুমি যাবে তো বিশু
কাকার সাথে আমাদের বিয়ের কথা বলতে?
নিজের কান কে বিশ্বাস করতে
পারল না লেখা। এসব সে কী শুনছে? নিজের মনের
ভাব গোপন করল লেখা। কথা বেরোচ্ছে না। কেটে কেটে তাও বলল,
- এ-খ-ন
যা-ও-য়া-টা...
- না না মা। এখন কেউ
নেই বাড়িতে। বিশু কাকা তো বিসর্জনের টিমে আছে। রাত হবে ফিরতে আর কাকীমাও
সন্ধ্যেবেলা বরণে গিয়েছিল।
- সন্ধ্যেবেলা
গিয়েছিল। এতক্ষণ কী থাকবে? আজই যাওয়া ভাল। বিজয়াটাও সারা হবে
আর তোদের বিয়ের কথাটাও বলা হবে।
- ঠিক আছে। তুমি
এখনই যাও তা হলে। জিতা কে আমার হয়ে সরি বলতে ভুলো না।
লেখা কোনোমতে শাড়ি টা বদলালো।
পার্সটা নিয়ে বেরোতে যাবে। রূপ তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
- লাভ ইউ মা। আমি
গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নি।
লেখা বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা
লাগালো। তারপর সোজা হাঁটা দিল থানায়। কাছেই থানা। আজ তার জন্যই রূপের এইরকম
অবস্হা। যদি ছোটবেলায় রূপের সব চাহিদা যদি সে না মেটাতো, তাহলে হয়তো আজকের দিনটা হয়তো দেখতে হতো না। ছোটোবেলায়
দু-একবার রূপের প্রিন্সিপাল বলেছিলেন যে রূপের রাগ-জেদের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট
দেখাতে। লেখা ভেবেছিল ফালতু কেন পাগলের ডাক্তার দেখাবে ও রূপকে? রূপ কী পাগল নাকি? শুধু রাগ আর জেদ টা বেশী। এটা তো
হতেই পারে। বেশী পাত্তা দেয়নি। আজ নিজের মাথা দেওয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে হলো লেখার,
ইচ্ছে হলো মরে যেতে। বুঝল নিজের অজান্তে ছেলের কতবড় সর্বনাশ করে
ফেলেছে সে।
থানায় গিয়ে সব জানালো লেখা।
বাড়িতে এসে রূপকে গ্রেফতার করল পুলিশ। ততক্ষণে সব জানাজানি হয়ে গেছে। বাড়ি লোকে
লোকারণ্য। রূপ রাগে চিৎকার করে কী সব বলছে। কিছুই কানে ঢুকছে না এখন লেখার। সে
পাথর হয়ে গেছে। ইন্সপেক্টার এগিয়ে আসলে লেখার স্বম্বিত ফিরল।
- মা হয়ে নিজের
ছেলেকে ধরিয়ে দিলেন? কেন?
- আমি ভাল মা হতে
পারিনি। আমার শিক্ষা খারাপ ছিল অফিসার। যাতে ও সঠিক শিক্ষা পায় তাই ধরিয়ে দিলাম।
আমি তো ওর মা। কী করে ওর খারাপ চাইবো? ভাববেন না। রূপের
বিরুদ্ধে আমি কোর্টে বয়ান দিতেও রাজি।
(সমাপ্ত)
(একটু বড়
হয়ে গেল গল্পটা। কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন। আপনাদের উৎসাহই আমার পথ চলার পাথেয়।)
-------------------------------------------------------------------------------------------
আয়না
লেখিকা- সুস্মিতা বসু
প্রজ্ঞার দ্বিতীয়বার মা হবার
খবরে উজান, প্রজ্ঞার শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ঊর্মি সবাই খুশি। ঝিল্লির ভাই বা বোন
আসছে জেনে বাড়ির সবাই আনন্দে মাতোয়ারা। প্রজ্ঞাও খুশি কিন্তু একটা আশঙ্কা তার মনে
কাঁটার মত বিঁধে আছে। তার আদরের ঝিম্লি খেলার সঙ্গী পাবে, তার
পরিবার পূর্ণ হবে সেই আনন্দের রেশ প্রজ্ঞার মনকে যতই প্রফুল্ল করুক না কেন কাঁটার
খচ্খচানিটা কিছুতেই যাচ্ছে না।
‘ঘুমোলে নাকি
প্রজ্ঞা?’ উজান রাতে বিছানায় শুতে এসে প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস
করে।
‘না কেন?’
‘একটা কথা সকাল
থেকেই জিজ্ঞেস করবো ভাবছিলাম, সকালে খবরটা পেয়ে তোমায় অত
চিন্তিত লাগছিলো কেন বলতো? তোমার মনে কোন সংশয় আছে?’ উজান জানতে চাইল?
‘না না সেরকম কিছু
নয়। আসলে ঝিল্লি সবে তিন, দুজনকে সামলাতে পারব কিনা সেটাই
ভাবছিলাম।’ প্রজ্ঞা উজান কে বলতে পারল না তার মনে কিসের আশংকা।
‘দূর পাগলি, এতো চিন্তার কি আছে? বাড়িতে মা আছে, ঊর্মি আছে, আর আমিও তো আছি। তুমি এতো ভাবছ কেন যে,
তোমায় একা সামলাতে হবে। ঝিল্লি কে ছোটবেলায় আমি দেখিনি? ওকে খাওয়ানো, ওর ন্যাপি পালটানো, ওকে ঘুম পাড়ানো...সবই তো আমি করেছি প্রজ্ঞা। তুমি একা কোথায়?’ বলে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরল উজান।
উজানের চওড়া রোমশ বুকে নিজের
নাক টা ঘসে দিল প্রজ্ঞা। উজান আরও নিবিড় ভাবে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরল। প্রজ্ঞার এই
আদরটা উজানের খুব প্রিয়। প্রজ্ঞাও উজানের বুকে মুখ লুকিয়ে নিজের সব আশংকাকে দূরে
সরিয়ে উজানের আদরে নিজেকে সমর্পণ করে।
সকালে ঊর্মি কলেজ যাওয়ার আগে
বলে গিয়েছিলো বিকেলে ফিরে শপিং করতে যাবে বৌমনির সাথে। প্রজ্ঞা রেডি হয়ে ছিল, ঊর্মির ফেরার খানিক বাদে ওরা বেরিয়ে পড়ল।
‘আজ কোন্ মলে যাবে
ঊর্মি? প্রজ্ঞা হেসে জিজ্ঞেস করল।’
‘তুমিই বল আজ কোথায়
যাবো? কারণ আজ তোমার জন্যই যাচ্ছি। এতবড় আনন্দের খবর শোনালে
আর তোমায় একটা গিফট দেবো না তা কি হয়?’
ঊর্মির কথায় প্রজ্ঞা হেসে
ফেলে। ‘পাগলি মেয়ে, এতে গিফট
দেবার কি হল?’
‘ওসব তোমায় ভাবতে
হবে না বৌমনি, তুমি শুধু বল কোথায় যাবে?’
‘আচ্ছা বাবা,
ঠিক আছে, লেক মলেই চল, ওটা
কাছে হবে।’
‘বেশ তাই চল’। ঊর্মি উবের বুক
করে ফেলল।
মলে আজ বেশী ভীড় নেই। ভালই
হল। ভীড়ে দমবন্ধ লাগে প্রজ্ঞার। ঝিল্লির হওয়ার সময়ও এরকম লাগতো।
‘বল বৌমনি তুমি কি
চাও?’ আজ তুমি যা চাইবে তাই দেবো।
‘বাবা কি ব্যাপার
বলতো? লটারি পেয়েছ নাকি? নাকি যখের ধন?’
‘আরে বাবা তা নয়। আজ
বাবার ক্রেডিট কার্ডটা আমি নিয়ে এসেছি।’ ঊর্মির কথায় প্রজ্ঞা হাঁ হয়ে যায়।
‘সেকি!! বাবা জানে?’
‘হ্যাঁ রে বাবা,
বাবাই তো বলল কার্ডটা নিয়ে যেতে। আমি বাবার থেকে টাকাই চেয়েছিলাম।
বাবা কারণটা জেনে কার্ডটা হাতে দিয়ে বলল যেটা মামনির পছন্দ হবে সেটাই দিবি। এটা
তোর আর আমার কম্বাইন্ড গিফট তোর বৌমনির জন্য।’
প্রজ্ঞার চোখে জল চলে এল।
শ্বশুরমশাই তাকে মামনি বলে ডাকে। অনেক ভাগ্য করে সে এমন শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে। ঘুরতে
ঘুরতে মৃগনয়নীর সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা শাড়ি দেখে চোখ আটকে গেল। দোকানে ঢুকে
শাড়িটা দেখতে চাইল। দোকানদার সামনে বড় আয়নাতে গায়ে ফেলে দেখতে বলল। প্রজ্ঞা শাড়িটা
নিয়ে গায়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।
‘একি!!! আয়নায় কাকে
দেখছে? কার প্রতিচ্ছবি ওটা? এতো পুরো
তার মায়ের মত দেখতে একজন......সেই বড় বড় চোখ, কপালে বড়
টিপ...... চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রজ্ঞা। এ কি সম্ভব? হ্যাঁ
সবাই বলে সে নাকি তার মায়ের মত দেখতে কিন্তু মায়ের ছবি সে আয়নায় কি ভাবে আসবে?
নাকি এটা হ্যালুসিনেসন?’
প্রজ্ঞার শরীর খারাপ করতে
লাগলো। ঊর্মিকে বলল সে বাড়ি ফিরবে। ঊর্মি তাড়াতাড়ি উবের বুক করে বৌমনি কে নিয়ে
বেরিয়ে এল মল থেকে। অবশ্য বেরবার আগে শাড়িটা কিনে নিতে ভুলল না। সে বুঝে গেছে
বৌমনির ওটা পছন্দ হয়েছে।
প্রজ্ঞার শরীরে আনচান ভাব
নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। শাওয়ার খুলে দাঁড়ালো। ঠাণ্ডা জলের ঝিরিঝিরি ধারায় তার শরীরের
অস্থিরতা আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রজ্ঞা ভাবল এই সন্ধেবেলায়
চুল ভেজাল...... যদি ঠাণ্ডা লাগে......তাই হেয়ার ড্রায়ার টা নিয়ে চুল শোকানোর জন্য
আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নাহ এখন তো আয়নায় সে নিজেকেই দেখছে......।।হাউসকোট পরে চুল
ড্রাই করছে। চুলটা শুকিয়ে কপালে সিঁদুর ছোঁয়াতে গিয়ে আয়নায় চোখটা পড়তেই আবার মায়ের
মুখটা ভেসে উঠলো। মায়ের মুখে একটা হাসি...... কিসের হাসি......... সে আবার মা হতে
চলেছে তাই?? নাহ এতো সেই হাসি নয়...... এই
হাসি যেন অন্য কিছু বোঝাতে চাইছে...... বলছে যেন ‘এবার আমি
দেখব তুই কি করিস?’
--------------------
‘বাপী, মা দাদাভাই কে বেশী ভালবাসে, আমাকে নয়।’ প্রবল
অভিমানে প্রজ্ঞা সুধাংশু বাবুর কোলে মুখ গুঁজে দিল। সুধাংশু বাবু মেয়ের মাথায় হাত
বুলিয়ে বললেন ‘নারে মা, তোদের মা
দুজনকেই সমান ভালবাসেন’।
‘না না, মোটেই না। দাদা দুষ্টুমি করলেও মা কিছু বলে না কিন্তু আমি করলেই মা আমাকে
ধরে দু এক ঘা লাগিয়ে দেয়। যখন দাদা আমায় মারে তখনো মা দাদাকে মিছিমিছি বকে। সেটা
আমি বেশ বুঝতে পারি। দাদাকে মাংসের ভালো ভালো পিস গুলো দেয়। বড় মাছ দাদার জন্য।
দাদার জন্মদিন করে, কই আমার তো করে না, বললে বলে মেয়েদের নাকি জন্মদিন করতে নেই। কেন বাপী? দাদা
কে কোন কাজ করতে দেয় না অথচ আমায় খালি কাজ করতে বলে।’ চোখে জল চলে আসে প্রজ্ঞার।
সুধাংশু বাবু বোঝেন তার মেয়ে কোনটাই ভুল বলছে না। পরমার এই ছেলে মেয়ের মধ্যে তফাৎ
টা তিনিও বোঝেন। বহুবার বারণ করেছেন পরমাকে কিন্তু পরমা কিছুতেই তার কথা শোনেনি।
আজ মেয়ে বড় হয়েছে, সে এই তফাৎ গুলো এখন বুঝতে পারছে। তিনি
প্রজ্ঞাকে বললেন ‘দেখ মা তুই একদিন বড় হবি, বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাবি, সেখানে আরও একজন বাবা
মাকে পাবি। তাহলে তোর ডাবল্ বাবা মা হয়ে যাবে আর তোর আদর ও ডাবল্ হয়ে যাবে।
কিন্তু দাদা তো এখানেই থাকবে, তার একজন বাবা মা থাকবে,
তাই তোর মা দাদাকে একটু বেশী ভালবাসে।’ সুধাংশু জানে এ শুধু
ছেলেভোলানো কথা, কিন্তু ৮ বছরের প্রজ্ঞাকে তিনি আর কি বা
বোঝাবেন?
প্রজ্ঞা ডাবল্ বাবা মা পাবে
শুনে খুশি হয়ে উঠলো। অবুঝ মন তার এতেই আনন্দ, সে দুজন বাবা
মার ভালবাসা পাবে। শিশুমন ভালবাসার কাঙাল। সে ছেলে মেয়ে বিভেদ জানে না। জানে
দাদাভাইয়ের যেমন মা তেমন তারও মা। তাই মায়ের ভালবাসা দুজনেই সমান পাবে। কিন্তু
মায়ের তফাৎ টা তার শিশুমনকে আঘাত করে। মা যখন তার চেয়ে দুবছরের বড় দাদাভাইকে জড়িয়ে
ধরে আদর করে তারও মন চায় মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পরমা মেয়েকে আদর করেন না তা নয়।
কিন্তু দাদাভাই আর তার আদরের মধ্যের সূক্ষ্ম তফাৎ প্রজ্ঞার চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এখন প্রজ্ঞা কলেজে পড়ে। এখন
তার বুঝতে অসুবিধা হয় না মা দাদাভাইকে তার চেয়ে বেশী ভালবাসে। একদিন রাগের মাথায়
মাকে সেকথা বলতে মা বলল... ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয়। দুজন সন্তান হলে একটু কম
বেশী হয়েই থাকে, এতে এতো রাগের কি আছে তোর?
ছোট থেকে দেখছি সব কিছুতে তুই দাদাকে হিংসা করিস।’
প্রজ্ঞা চুপ হয়ে যায়। সে বলতে
চায়......... ‘মা হিংসে করা তো তোমার জন্যই
শিখেছি। তুমি যদি দাদাভাই আর আমাকে সমান ভালবাসতে তাহলে আমি কেন হিংসা করতাম?
বাপীতো কখনো আমার আর দাদাভাইয়ের মধ্যে কোন তফাৎ করেনি তবে তুমি কেন
মা? তুমি কেন?’
প্রজ্ঞা জানে, বলে আর কিছু হবে না। দাদাভাইকে সে খুব ভালবাসে আর দাদাভাইও
তাকে। কিন্তু মায়ের দুরকম ভালবাসা প্রজ্ঞাকে তার মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে
যায়। মা তার কোনোদিন মনের সঙ্গী হতে পারেনি। এমন নয় যে মার তাকে যত্ন করেনি বা
তাকে অবহেলা করেছে। আসলে সেই আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মায়ের মনের কাছাকাছি সে যে নেই! তাই
নিজেও সে আড়াল তুলে দিয়েছে মা আর তার মধ্যে।
এম.এ পড়তে পড়তেই প্রজ্ঞার
বিয়ের ঠিক হয়ে যায়। পরমা মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে যান।। একদিন পরমা
দুপুরবেলা মেয়েকে ডাকেন তার ঘরে। প্রজ্ঞা গিয়ে দেখে পরমা তার গয়নার বাক্স খুলে
বসেছেন। পরমা মেয়েকে বলেন ‘ দেখ তোর বিয়েতে কি
দেব?’ বলে প্রজ্ঞাকে গয়না পরিয়ে দেন। মায়ের বিয়ের গয়না। চিক্
কাম নেকলেস, সিতাহার, টিকলি, চুড়, সোনার চুড়ি, ব্রেসলেট,
কানে ঝুমকো...... সব পরিয়ে মেয়েকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন।
প্রজ্ঞা নিজেকে চিনতে পারে না। অত গয়নায় তাকে রাজরানীর মত লাগছে। পরমা হেসে বলেন ‘
চিরকাল তো বলে এলি মা তোকে ভালবাসে না, দেখ সব
গয়না আমি তোকে দেবো বলেই আস্তে আস্তে গড়িয়ে রেখেছি। প্রজ্ঞা মাকে জড়িয়ে ধরে মনে
মনে বলে ‘মা আমি তোমার ভালবাসার ছোঁয়াটুকু শুধু চেয়েছি আর
কিছু নয়।’
বিয়ের পরদিন শ্বশুরবাড়ি চলে
যাবে প্রজ্ঞা, পরমা এসে মেয়ের কাছে বসেন।
বলেন ‘এবার তুই নিজের সংসারে যাচ্ছিস। দুদিন বাদে নিজে
মা হবি। তখন বুঝবি দুই সন্তানের মধ্যে তফাৎ এসেই যায়।’ প্রজ্ঞা দৃঢ় স্বরে বলে ‘না মা আমি কখনো দুই সন্তানের সন্তানের মধ্যে তফাৎ করবো না।
কখনো আমার বাচ্চাদের মধ্যে হিংসা আসতে দেবো না।’ এই কথা শুনে পরমা অদ্ভুত ভাবে হাসল। বলল ‘ঠিক আছে আমি দেখব তুই কি করিস?
------------------
আজ তবে মা আয়নার মধ্যে দিয়ে
সেইজন্যই হাসছিল...... এবার প্রজ্ঞাও তো দুই সন্তানের মা হতে চলেছে। তবে কি মায়ের
কথাই সত্যি হবে.........
তার বিয়ের দুবছরের মাথায় বাবা
মা সিকিম বেড়াতে গিয়ে একটা অ্যাক্সিডেন্টে একসাথে মারা যান। প্রজ্ঞা এই গভীর শোক
ভুলতে পেরেছিল চারমাসের মাথায় ঝিল্লিকে পেয়ে। তারপর থেকে শাশুড়ি মাধবী দেবী আর
শ্বশুর প্রনবেশ তাকে কখনো বাবা মার অভাব বুঝতে দেন নি। মাধবী দেবীও ঊর্মির চেয়ে
উজানকে একটু বেশীই স্নেহ করেন কিন্তু সেটা তার মা পরমার মত অত প্রকট নয়। তাই
প্রজ্ঞা ঊর্মিকে তার বোনের মতই ভালবাসে। তাকে ননদ বলে না ভেবে ছোট বোনই ভেবেছে।
মাধবী দেবীর ঊর্মির প্রতি ভালবাসার ফাঁকগুলো প্রজ্ঞা তার ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করে
দেয়। ঊর্মিও সেটা বোঝে। তাই দাদার থেকে বৌমনিকেই সে বেশী ভালবাসে। ভালবাসা বিনিময়ে
শুধু ভালবাসাই চায় অন্য কিছু নয়।
প্রজ্ঞা মনে মনে নিজেকে কথা
দেয় সে কিছুতেই তার দুই সন্তানের মধ্যে ভালবাসার পার্থক্য করবে না। কিছুতেই নয়।
প্রজ্ঞার ফুলে ওঠা পেট দেখে
ঝিল্লি বলে ‘মা তোমার পেটে কি ঢুকেছে?
ফুটবল?’
প্রজ্ঞা হেসে বলে ‘না সোনা, তুমি তো পুতুল খেল...তাই ভগবান
আমার পেটে একটা জ্যান্ত পুতুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর কদিন পরেই পুতুলটা বেরিয়ে এসে
তোমার সাথে খেলবে।’
‘আমার সাথে খেলবে?
এটা আমার পুতুল হবে মা?’
‘হ্যাঁ ঝিল্লি এটা
তোমার পুতুল।’
প্রজ্ঞা ঝিল্লিকে নিয়ে খাটে
শুয়ে কথা বলছিল। খাটের উলটোদিকের ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় তাকিয়ে দেখে মায়ের সেই
হাসিমুখ। প্রজ্ঞা চোখ সরিয়ে নেয়। আজকাল প্রজ্ঞা আয়না দেখাই ছেড়ে দিয়েছে।
আজ ঝিল্লি বাবার সাথে
নার্সিংহোমে মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে। তার একটা ভাই হয়েছে। দুদিন মাকে দেখেনি।
প্রজ্ঞা আজ উজানকে বলেছে মেয়েকে নিয়ে যেন বিকেলে একবার আসে।
ঝিল্লি ঘরে ঢুকে দেখে মায়ের
কোলে একটা ছোট্ট পুতুল তোয়ালে দিয়ে মোড়া। প্রজ্ঞা মেয়েকে কাছে ডাকল। ছেলেকে
ঝিল্লির সামনে এনে বলল ‘দেখো ঝিল্লি এটা
তোমার সেই পুতুল। আজ থেকে একে তুমি ভাইটু বলবে, কেমন।’
‘মা এটা আমার জন্য?
এটা আমার ভাইটু।’
‘হ্যাঁ ঝিল্লি’,
বলে প্রজ্ঞা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করল।
‘তাহলে চল মা
ভাইটুকে নিয়ে আমরা বাড়ি যাই।’
‘হ্যাঁ ঝিল্লি,
কাল সকালেই আমরা ভাইটু কে নিয়ে বাড়ি যাবো। আজ তুমি বাবার সাথে বাড়ি
যাও। কাল আমরা সবাই বাড়িতে ভাইটুর সাথে খেলবো।’
ঝিল্লি আনন্দে বাবার হাত ধরে
বেরিয়ে গেল। প্রজ্ঞার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তার খুব চিন্তা ছিল
ঝিল্লি ভাই কে দেখে কি করবে...কিন্তু ঝিল্লিকে সে বোঝাতে পেরেছে। ঝিল্লির মনে কোন
ক্ষোভ সে তৈরি হতে দেয় নি।
প্রজ্ঞা পরদিন ছেলেকে নিয়ে
বাড়ি ফিরল। ঝিল্লি তো আনন্দে লাফাচ্ছে। তার ভাইটু এসেছে। উজান ছেলের জন্য ঘরে সব
ব্যবস্থা করে রেখেছে। প্রজ্ঞা ঝিনুককে বেবিকটে শুইয়ে দিলো। প্রজ্ঞা তার ছেলের নাম
রেখেছে ঝিনুক। ঝিল্লির ভাই ঝিনুক। মাধবী দেবী ঘরে ঢুকে ঝিল্লি কে বললেন, ‘ঝিল্লি ভাইয়ের গায়ে হাত দেবে না। ভাইয়ের লেগে যাবে।’ প্রজ্ঞা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে ‘না মা ঝিল্লিকে কিছু বলবেন না। ঝিল্লি জানে ওর পুতুলকে কিভাবে
যত্ন করতে হয়। তাই না ঝিল্লি’। ঝিল্লি থাম্মার কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু মায়ের কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ‘হ্যাঁ মা জানি তো।
আমি তো আমার পুতুলকে একদম আমার বুকে জড়িয়ে রাখি যাতে ওকে কেউ না নিতে পারে।’
প্রজ্ঞা হেসে মেয়েকে জড়িয়ে
ধরে বলে ‘হ্যাঁ ঝিল্লি সোনা তুমিও তোমার ভাইটুকে
এইভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকবে কিন্তু কদিন পরে। এখন ভাইটু খুব ছোট। আর একটু বড় হলে তুমি
ওকে কোলে নেবে, ওর সাথে খেলবে তারপর একদিন ওর সাথে স্কুলে
যাবে...... ঝিল্লি খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। প্রজ্ঞাও মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে
ধরে শান্তি পায়। তার ঝিল্লি তার ঝিনুক তার দুই চোখের মনি সে দুজনকে সমান ভালবাসবে।
একদিন ঝিল্লি দেখে ভাইটুকে
বুকে নিয়ে মা দুধ খাওয়াচ্ছে। ঝিল্লি আস্তে আস্তে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলে
না। অবাক হয়ে দেখে। ঝিল্লি খুব ছোট বয়সেই বুকের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল তাই এটা
নতুন ব্যাপার তার কাছে। প্রজ্ঞা বোঝে। সে ঝিল্লিকে বলে, ‘ঝিল্লি তুমি ভাত খাও, চকলেট খাও ফ্রুট
খাও কিন্তু ভাইটু ছোট ওত এসব খেতে পারবে না, ওর দাঁত ও নেই।
তাই ভগবান আমার কাছে ওর খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে, তাই আমি
ভাইটুকে দুধ খাওয়াচ্ছি। তুমি যখন ছোট ছিলে তোমাকেও খাইয়েছি।’ ঝিল্লি ঘাড় নেরে চলে
যায় খেলতে। প্রজ্ঞা ভাবে কি জানি ঝিল্লির মন খারাপ হল নাতো?
ছমাসের পর থেকে প্রজ্ঞা
ছেলেকে বোতলের দুধ খাওয়াচ্ছে। সেদিন দুধ তৈরি করে এনে দেখে ছেলে তখনো ঘুমোচ্ছে।
দুধটাও সামান্য বেশী গরম ছিল। তাই ভাবল এই ফাঁকে স্নান টা সেরে নি। স্নান করতে
করতেই ছেলের কান্নার আওয়াজ পেল প্রজ্ঞা। আজ বাড়িতে কেউ নেই। শ্বশুর শাশুড়ি গেছে
সামনে ঝিনুকের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রন করতে। ঊর্মি কলেজে। প্রজ্ঞা তাড়াতাড়ি জল
ঢেলে বেরিয়ে এসে দেখে ছেলের কান্না থেমে গেছে। তার ঝিল্লি দুধের বোতলটা নিয়ে
ঝিনুকের মুখে ধরে আছে। আর প্রজ্ঞা যেভাবে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে ঝিনুকের মাথায় আলতো
হাত বোলায়, ঝিল্লি ঠিক সেইভাবে ঝিনুকের
মাথায় হাত বোলাচ্ছে। প্রজ্ঞার চোখে জল চলে এল। সে দৌড়ে এসে তার ঝিল্লিকে জড়িয়ে
ধরল।
‘মা দেখো ভাইটু
কাঁদছিল, ওর খিদে পেয়েছিল, তাইতো আমি
ওকে দুধ খাওয়াচ্ছি। ঠিক তোমার মত। তাই না মা?’
হ্যাঁ ঝিল্লি ঠিক আমার মত।
উলটোদিকের আয়নায় চোখ পরে গেল প্রজ্ঞার। সেখানে মায়ের ছবিটা ঝাপসা। সেখানে শুধু
প্রজ্ঞা, ঝিলিক আর ঝিনুক।
‘আমি পেরেছি মা আমি পারব।’ প্রজ্ঞা
অস্ফুটে বলে ওঠে।
------------------------------------------------------------------------------------------
ডেলি প্যাসেঞ্জার
লেখিকা- Sanchari
Sankar
লোকাল ট্রেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক
তাঁর স্ত্রী কে নিয়ে উঠেছেন, ডাক্তার দেখবেন 11 টায়, তার আগে নাম
লেখাতে হবে, তাই লোকাল ধরলেন, কিন্তু জায়গা পেলেন না। যদিও অনেক সিট ফাঁকা, কিন্তু দেশলাই কাঠি বা রুমাল দিয়ে রাখা,
বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে
সিট পেলেন না, ভদ্রমহিলা রীতিমতো রেগে একটা সিটে
বসতে যাবেন অমনি মাসিমা ওখানে লোক আছে।
কোথায় বাবা কাউকে তো দেখতে
পাচ্ছি না,
না মানে পরের স্টেশন থেকে
উঠবে।
ও তাই বল, আমরা কি আগের স্টেশন থেকে দাঁড়িয়ে যাব? আর তোমার বন্ধু পরের স্টেশন এ এসে বসবে? কোন কালের লাটসাহেব সে? বেশ কিছু বাগবিতন্ডার পর জোর করেই বসলেন ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক।
সক্কাল সক্কাল মুখ খারাপ
করাবেন না,
এখন ডেলি প্যাসেঞ্জার যাবে, আপনারা তো পরে ফাঁকা ট্রেনে আসতে পারেন।
কেন আসে এই সময়, ফালতু যত সব ....
পরের স্টেশন এ সিধু দা এলেন, জায়গা কৈ রে রাজু?
আজ আর জায়গা হল না সিধু দা, ওই মাসিমা.... আর বোলো না...
কুড়ি বছর পর সিধু দা কে নিয়ে
যাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী ডাক্তার এর এপয়নম্যান্ট, সকাল বেলায় দেখেন বাড়িতে, হাসপাতালে অনেক
সময় লাগে,
ট্রেনে উঠে সিধু দা জোরে ডাকলো রাজু আছিস নাকি রে?
কে রাজু ? কোন রাজু? রাজু গেঞ্জি
জাঙ্গিয়া নাকি চানাচুর? হাতকাটা রাজু,,
বেশ কিছুক্ষণ আওয়াজ শুনে একটা
গলি তে কোনোমতে যেতে পারলেন ।
দেখলেন রাজু তাস নিয়ে ব্যস্ত, রাজু? আবার ডাকলেন,
আরে কে রে নাম টার যা তা করছে?
সিধু দা? তা হঠাৎ আবার কি মনে করে,
রিটেয়ার করে এই ট্রেনে?
ওই ডাক্তার,,
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বয়স হয়েছে তো। সিধু দা
দমদমের আগে এই লাইনে হবে না
গো,
মানিক ওদিকে কাছে কেউ আছে?
সবই তো জানো দাদা, এই সময় টা অ্যাভয়েড করে আসবে, বয়স হচ্ছে তো;
আমরা এখনো ডেলি
প্যাসেঞ্জার দাদা তুমি তো রিটেয়ার করেছো....
-------------------------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment